অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

সিএমপিতে কার্যক্রর হয় না পুলিশ সদর দপ্তরের আদেশ

0
.

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপিতে) অকার্যকর পুলিশ সদর দপ্তরের আদেশ! সিএমপি’র রিজার্ভ শাখায় কর্মরত ‘আরওআই’ আকবর সদর দপ্তরের আদেশ অকার্যকরে মুখ্য ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ করেছেন খোদ পুলিশ সদস্যরাই ।

সূত্র জানায়, প্রতি মাসে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সিএমপি’তে উপ-পরিদর্শক থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত ৭০ থেকে ৮০টি বদলির আদেশ আসে। একই সময় সমপরিমাণ আদেশ আসে সিএমপি’তে যোগদানের। হেডকোয়ার্টার থেকে বদলি কিংবা সিএমপি’তে যোগদানের আদেশপত্র আসলেই পুলিশের রিজার্ভ শাখায় তা কার্যকর করতে শুরু হয় বাণিজ্য।

এ বাণিজ্যের নেতৃত্ব দেন সিএমপি’র রিজার্ভ শাখায় কর্মরত ‘আরওআই’ আকবর হোসেন। তিনি বদলির আদেশ কার্যকরের সিসি নিতে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেন বলে অভিযোগ আছে। তার ক্ষমতা যেন পুলিশ কমিশনরের চেয়েও বেশী।

সিএমপি’তে যোগদান করা পুলিশ সদস্যদের পছন্দনীয় থানা কিংবা ইউনিটে পদায়ন করতে মোটা অংকের টাকা নেন। আবার ‘ভালো স্টেশনে’ রয়েছে এমন কোন পুলিশ সদস্য বদলি হলেও তা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অকার্যকর করে রাখার অভিযোগ রয়েছে আরওআই আকবর হোসেনের বিরুদ্ধে।

পুলিশের উপ-পরিদর্শক, সার্জেন্ট ও সহকারী উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বদলি করা হলেও তারা বছরের পর বছর কর্মস্থল ছেড়ে যান না। আবার কোন কারণে বদলির সিসি দেয়া হলেও কিছু দিন পর পূনরায় তদবির করে চলে আসেন পূর্বের কর্মস্থলে।

সিএমপি’র বিভিন্ন পদের শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বার বার বদলির পরেও একই কর্মস্থলে বহাল রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বার বার বদলির আদেশ পাঠানোর পরেও আর.ও আই আকবরের যোগসাজসে তারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন অদৃশ্য শক্তির ইশারায়।

সিএমপি’র কোতোয়ালী থানাধীন এনায়েত বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) হারুন একই থানা এলাকায় দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর ধরে রয়েছেন বহাল তবিয়তে। গত ১৮ বছর ধরে এসআই হারুন ঘুরে ফিরে কোতোয়ালী থানা, পাথরঘাটা পুলিশ ফাঁড়ি ও এনায়েত বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত রয়েছেন। দীর্ঘ ১৮ বছর একই থানায় ঘুরে ফিরে থাকার কারণে ইতোমধ্যে মাদক ব্যবসার ৯০ জনের পৃষ্টপোষকের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে এসআই হারুনের নাম। এ ছাড়া সম্প্রতি র‌্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত লাভ লেইন ঝাউতলার হাবীব এবং ইছহাক দুজনই এসআই হারুনের রোষানলের শিকার বলে জানা গেছে।

দীর্ঘদিন ধরে এক জায়গায় অবস্থানের ফলে নানান অপরাধের সাথে যুক্ত হচ্ছেন এসআই হারুনসহ পুলিশের শতাধিক কর্মকর্তারা। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এসব কর্মকর্তাদের নামে বারবার বদলি আদেশ পাঠানো হলেও সিএমপিতে তা অকার্যকর হচ্ছেনা।

অভিযোগ রয়েছে পছন্দমত জায়গায় পদায়ন না হওয়ায় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই পুলিশের শতাধিক কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে একই এলাকায় কর্মরত আছেন।

বদলির আদেশ ঠেকিয়ে বহাল তবিয়তে থাকা এসব পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেরই আবার মাদক ব্যবসার পৃষ্টপোষকের হিটলিষ্টেও নাম রয়েছে। এদের মধ্যে সিএমপি’র সাবেক এবং বর্তমান পাঁচ প্রভাবশালী ওসির নামও রয়েছে।

সিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) মাসুদ উল হাসান বলেন, ‘সিএমপি’তে কিছু পদ শূন্য থাকায় অনেককে বদলির আদেশ হওয়ার পরেও ছাড়া হয়নি। লোক নাই বলেই মূলত অনেক সময় আদেশ কার্যকর করা সম্ভব হয় না। দ্রুত এমন সংকট কেটে যাবে বলে দাবী করেন সিএমপি’র এ শীর্ষ কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, বদলি ও যোগদানের বিষয়ে কারো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই মন্তব্য করে এ কর্মকর্তা বলেন তবুও কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জানা যায়, হালিশহর থানায় উপ-পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত মো. ইউনুছ মিয়াকে গত বছরের ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম রেঞ্জে বদলি করা হলেও এক বছরেও তিনি কর্মস্থল ত্যাগ করেননি। ফলে সেখানে অন্য কোনো কর্মকর্তা এখনো যোগ দিতে পারেননি।

বিষয়টি নিয়ে এসআই ইউনুছ মিয়া বলেন, থানায় উপ-পুলিশ পরিদর্শক কম থাকায় তাঁকে ছাড়া হয়নি। তিনি নিজেও কয়েকবার চলে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ করেছেন দাবী করে বলেন তাঁর জায়গায় যার আসার কথা তিনি আসেননি। চাকরির বয়স ৩৫ বছর হয়ে গেছে, ডিউটির চাপ আর নিতে পারছেন না বলেও জানান তিনি।

গত বছরের (২০১৭) ২৪ ডিসেম্বর চান্দগাঁও থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো.হেলাল উদ্দিনকে পিবিআইতে বদলির পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনো চান্দগাঁও থানায় কর্মরত আছেন। কার্যকর হয়নি সদর দপ্তর থেকে পাঠানো তাঁর বদলির আদেশ।

একইভাবে গত ২৭ মার্চ চান্দগাঁও থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক সাইফুল ইসলামকে বদলি করা হলেও তিনি এখনো কর্মস্থল ছাড়েননি। গত অক্টোবর মাসে খুলশী থানার এস আই সুমনকে বদলির আদেশ দেয়া হয় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। দু’বার তাঁর বদলির আদেশ সিএমপিতে আসলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি। প্রথমবার চট্টগ্রাম রেঞ্জে এবং দ্বিতীয়বার ঢাকা পিবিআইতে তাঁকে বদলি করা হলেও এখনো তিনি খুলশী থানায় রয়েছেন।

বাকলিয়া থানার এএসআই ফোরকানকে গত বছরের মার্চ মাসে চট্টগ্রাম রেঞ্জে বদলি করা হয়। কিছু দিন কক্সবাজারে কর্মরত থাকার পর পূনরায় বাকলিয়া থানার ওসির ব্যক্তিগত তদবিরে তিনি বাকলিয়া থানায় যোগদান করেন। ইয়াবা সিন্ডিকেটেও তাঁর নাম রযেছে বলে একাধিক সুত্র জানায়।

বায়েজিদ থানার এএসআই নাছের হোসেন ও রযেছে তদবিরবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকায়। বর্তমানে তিনি কোতোয়ালী থানায় কর্মরত। এএসআই বাপ্পু সেনকে নগর গোয়েন্দা শাখা হতে এসপিবিএন’ এ বদলি করা হলেও অদৃশ্য কারণে তার বদলির আদেশ বাতিল হয়। ট্রাফিক প্রসিকিউশনের উত্তর জোন হতে গত বছরের মার্চ মাসে বদলি করা হয় এএসআই ইব্রাহিমকে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তিনি এখনো স্বস্থানে বহাল তবিয়তে আছেন।

একই বিভাগের সার্জেন্ট আনোয়ার গত দেড় বছর ধরে প্রসিকিউশনের কর্মরত আছেন। সেখানে ইতিপূর্বে কোন পুলিশ কর্মকর্তা এক বছরের অধিক না থাকলেও পুলিশ কমিশনার এক বন্ধু জনৈক মাস্তান মামা’র মাধ্যমে তিনি এখনো বহাল তবিয়তে আছেন।

এ ছাড়া আরওআই আকবর হোসেন তারই নিজ জেলা নোয়াখালীর আরমান নামে এক এএসআইকে দিয়ে যাবতীয় লেনদেন’র কাজ সম্পাদন করে থাকেন। সিআরবি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ টিএসআই রফিক, চাক্তাই ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইফুদ্দিনও গত দু বছর ধরে রয়েছেন এসব ফাঁড়ির দায়িত্বে। এসব ফাঁড়িতে এক বছরের অধিক কোন পুলিশ কর্মকর্তার চাকুরীর রেকর্ড নেই।

একটি সুত্র জানায়, কয়লার ডিপু ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই বাবুল আক্তার বদলির জন্য আরওআই আকবরকে ২ লাখ টাকা দেয়ার পরেও কোন কাজ না করায় এসআই বাবুল টাকা ফেরত চেয়েছেন। আরওআই আকবর এখনো সে টাকা ফেরত দেয়নি। তবে এ বিষয়ে এসআই বাবুল আক্তারের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শতাধিক উপ-পরিদর্শক, সার্জেন্ট ও সহকারী উপ-পরিদর্শক ঘুরে ফিরে সিএমপিতেই রয়ে যান। তাদেরকে বদলি করা হলেও সুকৌশলে পছন্দমত পোস্টিংয়ের অপেক্ষায় থাকেন। বদলি হয়েও কর্মস্থল না ছাড়া কর্মকর্তারা হলেন-উপ-পরিদর্শক গোবিন্দ চন্দ্র দাস, নুরুল আবছার ভুঁইয়া, মোবারক হোসেন, মো. মফিজুর রহমান, মো. তোফাজ্জেল হোসেন, রিফাত আল জাবের, রুপেশ বড়ুয়া, মো. সাখাওয়াত উল্লাহ, সহকারী উপ-পরিদর্শক দিনমনি বড়ুয়া, মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, মো. শাহাদাত হোসেন, মো. মাসুদ হাসান অন্যতম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক সদস্য বলেন, টাকা ছাড়া রিজার্ভ শাখায় কর্মরত আরওআই কথাও বলেন না। উনার একটি সিন্ডিকেট আছে। ঘুরেফিরে এমন কর্মকর্তাদের কাজই করেন তিনি। খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন প্রতিটি থানায় ঘুরেফিরে কারা কর্মরত আছেন। তারা পছন্দমত পোস্টিং না পেলেই আরওআইকে ম্যানেজ করে বদলির আদেশ মানেন না।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিএমপি’র রিজার্ভ শাখায় কর্মরত আরওআই আকবর হোসেন বলেন, সিরিয়াল অনুসারে ছাড়া হচ্ছে। সিএমপিতে সাব-ইন্সপেক্টরের বড়ই সংকট। এখনো ২৫০ সাব ইন্সপেক্টর সংকট আছে। সংশ্লিষ্ট স্যাররা ছেড়ে দিতে বললেই আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। অর্থ লেনদেনের বিষয় অস্বীকার করে তিনি বলেন, একজন আসলে একজনকে ছেড়ে দিব। কিন্তু আসতেছে কম, যাবে বেশি। যে কারণে ছাড়া হয় না। এবছর ১০-১৫ জন আসলেও বদলি হয়েছে ৪৫ জন। এই কারণে কমিশনার স্যারের নির্দেশেই ছাড়া হচ্ছে না।