অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

পতেঙ্গায় মাল্টিপারপাস কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ নিয়ে চরম মতবিরোধ

0
.

চট্টগ্রামের পতেঙ্গার লালদিয়ার চর এলাকায় মাল্টিপারপাস কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বন্দর ব্যবহারকারীরা। বন্দরের আর্থিক সক্ষমতা থাকার পরেও কেন এটি বিদেশী কোম্পানিকে দেয়া হবে এ নিয়েও চরম ক্ষোভ রয়েছে বন্দর ব্যবহারকারীদের মাঝে।

বর্তমানে টার্মিনাল নির্মাণকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের মাঝে। পতেঙ্গা নৌবাহিনীর বোট ক্লাব সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীর পাড়ে টার্মিনালটি নির্মিত হলে বন্দরের জাহাজ জট ও পণ্য খালাসে ভোগান্তি নিরসন হবে দাবি বন্দর কর্তৃপক্ষের।

বন্দর কর্তৃপক্ষের এমন দাবীর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ হলে যানজট ও জনভোগান্তি বাড়বে।’ তার মতে, লালদিয়া কিংবা পতেঙ্গা টার্মিনাল নির্মাণ না করে দ্রুত বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা দরকার। কর্ণফুলী নদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বিদেশী কোম্পানিকে ২৫ বছরের জন্য টার্মিনালের দায়িত্ব দেয়া কতুটুকু যুক্তিযুক্ত সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বন্দর ব্যবহারকারীরাও। এতে করে বন্দরের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে বন্দরের অর্থায়নে না করে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় টার্মিনাল নির্মাণের এ উদ্যোগে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। বন্দরের আর্থিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন বিদেশী কোম্পানিকে লিজ দেয়া হবে এমন প্রশ্ন বন্দরসংশ্লিষ্টদের।

বিদেশী কোম্পানিকে টার্মিনাল নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা লিজ দেয়ার সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বন্দর পতেঙ্গা আসনের সাংসদ আব্দুল লতিফ।

লতিফের প্রশ্ন বন্দরের হাজার হাজার কোটি টাকা থাকা সত্ত্বেও এ টাকা সিন্দুকে ভরে রেখে আমরা এর-ওর কাছে কেন হাত পাতছি? তিনি বলেন, ‘পত্রিকায় নিউজ হয় বন্দরের কাছে রয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সময় রিক্যুজিশন দিয়ে অন্যান্য খাতে টাকা নেয়া হয়েছে, কিন্তু বন্দরের উন্নয়ন কেন হয়নি?’
তিনি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘বন্দরের উন্নয়ন কী বন্দরের নাকি দেশের জন্য? অর্থনীতির জন্য, যদি তাই হয়ে থাকে তবে এ টাকাগুলো আমরা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে রেখে দিয়ে কেন এ দুয়ার ও দুয়ার ঘুরছি? মাত্র তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে যে লোকগুলো আগ্রহ প্রকাশ করছে তাদের কাছে কি বন্দরের চাইতেও বেশি অর্থবিত্ত আছে? কারো নেই, কোন একটা ব্যাংকের কাছে চুক্তিভিত্তিক টাকা নিয়ে তার এ প্রকল্প কাজ করবে।’

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এম এ লতিফ আরো বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশ্বের সর্বাধুনিক সুবিধা পাওয়া বন্দরগুলোর মতো গড়ে তোলা কোনো ব্যাপার নয়। তবে বিদেশীদের নিকট ধর্না না দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে এ টার্মিনাল নির্মাণ করা উচিত।’

বন্দর সূত্রে জানা যায়, দেশের আমদানি রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করা ও চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।

বন্দরকে যুগোপযোগী করে নগরীর বিমানবন্দর রুটের লালদিয়া চর এলাকায় ৫২ একর জায়গার উপর প্রস্তাবিত টার্মিনাল নির্মাণ কাজ আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, দুবাই ও ফ্রান্সের ৫টি কোম্পানি ইতিমধ্যে পিপিপি’র অধীনে টার্মিনাল নির্মাণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড, ভারতীয় আমদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনোমিক জোন লিমিটেড, ফ্রান্সের ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড, চীনের চায়না হারবার এবং সিঙ্গাপুরের গ্লোবাল পোর্ট সার্ভিসেস। এগুলোর মধ্যে যে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের সাথেই চুক্তি করবে চবক।

চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল খালেদ ইকবাল সম্প্রতি তার দায়িত্ব হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বলেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে বন্দরকে সর্বাধুনিক সুবিধায় উন্নীত করার বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সক্ষমতা বাড়াতে ইতিমধ্যে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। যা একটা একটা করে বর্তমানে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতা হচ্ছে লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। এ টার্মিনাল নির্মিত হলে ১৯০ মিটারের বৃহৎ আকার চারটি জাহাজ আসতে পারবে। যা দিয়ে কন্টেইনার ও কার্গো দুটোই হ্যান্ডলিং করা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনালটা শুরু থেকে বিভিন্ন পাবলিক পার্টনারশিপ পিপিপি প্রক্রিয়ায় গিয়েছি। লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের দরপত্র আহবানসহ যাবতীয় পর্যবেক্ষণ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। ৭টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়ে ৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে চূড়ান্ত অবস্থানে। এর মধ্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করে শীঘ্রই এ টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শুরু হবে। সুতরাং যাদের টাকা আছে তারা এসে বানিয়ে দিয়ে যাবে। এতে করে তারাও যেমন এখাত থেকে লভ্যাংশ পাবে পাশাপাশি আমরাও এ টার্মিনাল ব্যবহার করে লভ্যাংশ পাবো।’

বন্দর সিবিএ সভাপতি আবুল মনসুর বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারে বন্দরের টাকা থাকা সত্ত্বেও লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ করতে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা কেন?’ তিনি লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ ও অপারেশনাল কার্যক্রম নিজেরা করার দাবি জানান।

তবে এ প্রকল্পকে চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে প্রথম পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্প উল্লেখ করে বিদায়ী বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বলেন, ‘এটি বেসরকারী কোন পোর্ট হবে না, নির্দিষ্ট চুক্তি ও শর্তের ভিত্তিতে ২৫/৩০ বছরের জন্য বিদেশী প্রতিষ্ঠান এ টার্মিনাল পরিচালনা করবে। আমরা ল্যান্ডলর্ড পোর্টের ভূমিকায় যাচ্ছি। পরবর্তীতে এটি চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নেবে।’

চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় বিদেশী কোম্পানিকে টার্মিনাল নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া দেশের জন্য হুমকি হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও নাগরিক উদ্যোগের প্রধান উপদেষ্টা খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘বিভিন্ন মাফিয়া গ্রুপ বিদেশী চটকদার নাম বলে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে চাইছে। আমরা কোনো অবস্থাতেই আমাদের স্পর্শকাতর অর্থনৈতিক একটা জায়গায় বিদেশী কেউ আসুক তা চাই না। জাতির পুঁজি রক্ষার জন্য কিংবা অর্থনীতি রক্ষার জন্য হলেও আমরা বিদেশী কারো হাতে বন্দরের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে পারি না। যদি বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে কিংবা জাহাজডুবির মত ঘটনা ঘটে তবে একটা জাহাজের জন্য পুরো বন্দরটাই অচল হয়ে যেতে পারে।’

লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরে চট্টগ্রাম কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন বাচ্চু বলেন, ‘টার্মিনালটি যত দ্রুত নির্মাণ হবে ততই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক প্রসার এবং বাণিজ্যিক আমদানি রপ্তানি পণ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে খালাসের ব্যবস্থা হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এ টার্মিনাল ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মাদার ভেসেলগুলি আউটার থেকেই পণ্য খালাস করছে যা অনেক সময়ের ব্যাপার। লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনালটি নির্মিত হলে জাহাজগুলি সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারবে, কম সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস হবে।