অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

লাগাম টেনে ধরা না গেলে ব্যাংকিং সেক্টর ধ্বংস হয়ে যাবে

0
কাদের গণি চৌধুরী।

ব্যাংকিং সেক্টরের হরিলুট চলছে। যে যেভাবে পারছেন লুটপাট করছেন ব্যাংকের টাকা। এনিয়ে পত্রিকায় ভুরি ভুরি নিউজ হচ্ছে। কেউ যেন দেখার নেই।অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখনি লাগাম টেনে ধরা না গেলে ব্যাংকিং সেক্টর ধবংস হয়ে যাবে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত মঙ্গলবার অর্থনীতি সমিতির এক সংবাদ সন্মেলনে যে তথ্য দিয়েছেন তা রীতিমত ভয়ংকর। তিনি জানান,ঠিক মতো হিসাবপত্র করলে দেশের অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক দলীয় বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদন দেয়। এসব ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ করা হয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের। এদের বিরুদ্ধে লুটপাটের বিস্তর অভিযোগ উঠে। প্রথমে কর্তৃপক্ষ এটা স্বীকার করতে চাইনি। যার ফলে একের পর এক ব্যাংক এখন দেউলিয়া হতে চলেছে।

.

আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও বেসিক ব্যাংকে একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত পরিচালকদের সম্পৃক্ততার খবর বের হয়েছে সংবাদপত্রে।

বর্তমান সরকারের পরপর দুই মেয়াদেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাতে ‘হল-মার্ক’ ও ‘বিসমিল্লাহ’র মতো বহুল আলোচিত আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে ছোট-বড় অসংখ্য কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসব আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের সম্পৃক্ততার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।

মহাজোট সরকার ২০০৯ সাল থেকেই রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ দিচ্ছে। এসব নিয়োগ নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা হচ্ছিল। অর্থমন্ত্রী বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, ব্যাংকের পর্ষদে রাজনৈতিক বিবেচনায় আগে অনেক নিয়োগ দিয়েছি। এবার নিয়োগ দেব সাবেক আমলা ও সাবেক ব্যাংকারদের। অর্থমন্ত্রীর এ ক্তব্যের কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল জারি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অর্থনীতিবিদ, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, ব্যবসায়ী এবং কমপক্ষে একজন নারী পেশাজীবীকে ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য করা হবে। কিন্তু গত ৮ বছরে তা মানা হয়নি, বরং সমাজসেবক আখ্যা দিয়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে পর্ষদ সদস্য বানানো হয়েছে। এদিকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের কার্যক্রমেও বিধি-নিষেধ আসতে পারে। চেয়ারম্যানের জন্য সুসজ্জিত কক্ষ থাকা; এমডির মতো চেয়ারম্যানদের অফিস করা; পর্ষদ বৈঠক ছাড়া পরিচালকদের নিয়মিত ব্যাংকে আসা-যাওয়াও ঠেকাতে অর্থ মন্ত্রণালয় এ নিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। গত আট বছরে সোনালী ব্যাংকে কাজী বাহারুল ইসলাম, অগ্রণী ব্যাংকে খন্দকার বজলুল হক, জনতা ব্যাংকে আবুল বারকাত, রূপালী ব্যাংকে আহম্মদ আল কবির, বেসিক ব্যাংকে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকে সাবেক নৌবাহিনী প্রধান এ. তাহের এবং বিডিবিএলে শান্তি নারায়ণ ঘোষ দুবার করে চেয়ারম্যান হন। পরিচালক হন মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী জান্নাত আরা হেনরী, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সুভাষ সিংহ রায়, ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি শাহজাদা মহিউদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাবেক ভিপি কে এম এন মঞ্জুরুল হক, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য খোন্দকার জাহাঙ্গীর কবির প্রমুখ। সোনালী ব্যাংকে ১৩ সদস্যের পর্ষদ থাকার কথা থাকলেও ৭ জনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ১৯ ডিসেম্বর। এখন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) আছেন মাত্র ৪ জন। সোনালী ব্যাংকেরই সাবেক কর্মকর্তা কাজী বাহারুল ইসলামকে দুই দফা চেয়ারম্যান করা হয়।

অবশ্য হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর দ্বিতীয় বার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি তিনি। অগ্রণী ব্যাংকে ১২ সদস্যের পর্ষদের ৮ জনেরই মেয়াদ শেষ। তাদের মধ্যে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলরাম পোদ্দার, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহসম্পাদক আবদুস সবুর, রহিমআফরোজ গ্রুপের পরিচালক নিয়াজ রহিম এবং স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা এম এ রউফ সরদার দুবার করে পরিচালক ছিলেন। আগে এসব পদে দুই দফায় ছিলেন অর্থ বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ইমদাদুল হক, আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য-বিষয়ক সহ-সম্পাদক নাগিবুল ইসলাম দীপু, সাবেক ডিআইজি সৈয়দ বজলুল করিম, সাবেক ব্যাংকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক রমণী মোহন দেবনাথ এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন। বিডিবিএলে শূন্য থাকা পাঁচ পরিচালকের পদে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুস্তম আলী আহমেদ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ এপতার হোসেন পিয়ার, দেওয়ান নুরুল ইসলাম, আইনজীবী আবদুস সালাম ও কাজী মোরশেদ হোসেন কামাল।

চমকে দেয়ার মতো আজ একটি প্রতিবেদন ছেপেছে বণিক বার্তা। পত্রিকাটির খবরে জানা যায় সররকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুলও ব্যাংক উদ্যোক্তা।

২০১১ সালের জুলাইয়ে ২৭তম কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সিদ্দিকী নাজমুল আলম। এর এক বছর পরই ব্যাংক উদ্যোক্তা বনে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের এ শিক্ষার্থী। ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া দ্য ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের ৩৯ ব্যক্তি উদ্যোক্তার একজনে পরিণত হন।

প্রতিষ্ঠাকালেই ব্যাংকটির ১০ লাখ শেয়ারের মালিক হন জামালপুরের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ঢাকায় আসা সিদ্দিকী নাজমুল আলম। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা হিসাবে ফারমার্স ব্যাংকের মূলধনে ছাত্রলীগের এ সাবেক সাধারণ সম্পাদক জোগান দিয়েছেন এক কোটি টাকা।

তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা বলছেন, নেতা হওয়ার পর আর্থিকভাবে অস্বাভাবিক উত্থান হয় নাজমুলের। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে তার লাইফস্টাইলে। দামি গাড়ি, ফ্ল্যাট, শহর ও গ্রামে বহুতল বাড়িসহ বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন তিনি।

ছাত্রলীগের পদে থেকে দামি গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে তখন সিদ্দিকী নাজমুল আলম সে সময় বলেছিলেন, তার বন্ধু মেহেদী হাসান গাড়িটি তাকে উপহার দিয়েছেন। ব্যাংকের শেয়ার কিনে উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়েও গতকাল একই কথা বলেন তিনি। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সিদ্দিকী নাজমুল আলমের সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ারের মালিক আমি নই। আমার বন্ধু মেহেদী হাসান ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালক। সে আমার নামে ব্যাংকটিতে এক কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে। শেয়ারবাজার বা ব্যাংক বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই আমার।

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় ব্যাংকের উদ্যোক্তা হওয়ায় লঙ্ঘিত হয়েছে সংগঠনের গঠনতন্ত্রও। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, বিবাহিত, ব্যবসায়ী ও চাকরিতে নিয়োজিত কোনো ছাত্র ও ছাত্রী ছাত্রলীগের নেতা হতে পারবেন না।

২০১১ সালের ১২ জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্বে ছিলেন সিদ্দিকী নাজমুল আলম। সে সময়ে ব্যাংকের উদ্যোক্তা হয়ে গঠনতন্ত্রের এ ধারা লঙ্ঘন করেছেন তিনি।

সিদ্দিকী নাজমুল আলমের পরিচিতজনদের উদ্ধৃত করে বণিক বার্তা জানায়, জামালপুরের পাথালিয়ার একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। তার বাবা ছিলেন খাদ্য বিভাগের কর্মচারী। একতলা টিনশেডের একটি বাড়ি ছিল তাদের। জামালপুর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সিদ্দিকী নাজমুল আলম সবার বড়।

তার সমসাময়িক সময়ে দায়িত্ব পালন করা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হওয়ার পর সবসময়ই আর্থিক টানাপড়েনে থাকতেন নাজমুল। কিন্তু ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর বদলে যায় তার জীবন। সাদামাটা জীবন ক্রমেই হয়ে ওঠে বিলাসবহুল। দলীয় পদকে এক্ষেত্রে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। উদ্যোক্তা হয়েছেন ব্যাংকেরও।

মোট ৩৯ জন ব্যক্তি উদ্যোক্তা ও ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগে ৪০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ২০১৩ সালে যাত্রা করে নতুন প্রজন্মের বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক। ব্যাংকের মোট ৪০ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার শেয়ারের মধ্যে ৩৯ জন ব্যক্তি উদ্যোক্তার শেয়ার ২৯ কোটি ৩৬ লাখ ১০ হাজার। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা হিসেবে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ রয়েছে ২৯৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৭৩ দশমিক ১১ শতাংশ। বাকি ১২ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর মূলধন ১০৮ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির প্রভাবশালী অন্যান্য উদ্যোক্তার মধ্যে আছেন— সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ডের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. মাহবুবুল হক বাবুল চিশতী, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মেয়ে নাফিসা কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন (মুনতাসীর মামুন), লুসাকা গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান সরকার, মোহাম্মদ মাসুদ, আজমত রহমান, ড. মোহা. আতাহার উদ্দিন ও অমিকন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মো. মেহেদী হাসান।

বুধবার বণিক বার্তার আরেক প্রতিবেদনে ফারমার্স ব্যাংকের যে চিত্র ফূটে উঠেছে এটি খুবই বেদনাদায়ক।টাকা না থাকায় ব্যাংকটি কর্মচারিদের বেতন দিতে পারছে না।

নগদ টাকা না থাকায় প্রায় দুই মাস ধরে ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বন্ধ। অন্যদিকে জমা অর্থ তুলে নিতে মরিয়া আমানতকারীরা। প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংকটিতে ভিড় করলেও খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে তাদের। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এবার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে নজিরবিহীন অর্থ সংকটে থাকা ব্যাংকটির কর্মীদের বেতন পরিশোধ। চলতি মাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির পর্ষদ সদস্যরাই।

ফারমার্স ব্যাংকসংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, যাত্রা শুরুর মাত্র তিন বছরের মধ্যেই দেড় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এ জনবলের বেতন বাবদ প্রতি মাসে ব্যাংকটির ব্যয় হয় ৫ কোটি টাকার বেশি।

বিপুল সংখ্যক এ কর্মীর বেতন পরিশোধে সংকট হবে বলে স্বীকার করেছেন ফারমার্স ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির (ইসি) নতুন চেয়ারম্যান আজমত রহমানও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নগদ টাকার সংকটের কারণে আমানতকারীদের টাকাই এ মুহূর্তে পরিশোধ করতে পারছি না। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন দেব কোথা থেকে?

আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি ফারমার্স ব্যাংকে লোকবল নিয়োগেও নজিরবিহীন দুর্নীতি হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শনে উঠে এসেছে। আগ্রাসী মনোভাবের কারণে মাত্র তিন বছরেই ৫৬টি শাখা খুলেছে ব্যাংকটি। আর্থিক লেনদেন, রাজনৈতিক ও আত্মীয় পরিচয়ে ২০১৬ সালের মধ্যেই ফরমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৮৯। বর্তমানে এ সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে বলে ব্যাংকটি সূত্রে জানা গেছে।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত এ জনবলের বেতন-ভাতা বাবদ ২০১৬ সালেই ব্যাংকটিকে ব্যয় করতে হয়েছে সাড়ে ৫৩ কোটি টাকা। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছরের জুনে এসে ১৩ কোটি টাকা লোকসানে পড়েছে ফারমার্স ব্যাংক। একই সময়ে ৫৪টি শাখার মধ্যে ব্যাংকটির ২৮ শাখাই লোকসানে চলে যায়। এরপর থেকে আর্থিক বিপর্যয় আরো বেড়েছে ফারমার্স ব্যাংকের।

ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, খেলাপি ঋণসহ বিভিন্ন কারণে এরই মধ্যে ৭৫ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। কার্যক্রম শুরুর এত অল্প সময়ে এত বড় অংকের মূলধন ঘাটতির ঘটনা বাংলাদেশে এই প্রথম। আইন অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার যেকোনো ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা ঋণ দিতে পারে। কিন্তু আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ফারমার্স ব্যাংক ৯০ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে।

ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য চলতি বছর কয়েক দফায় নোটিস দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। তারল্য সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়ে আসছিল ফারমার্স ব্যাংক। এ কারণে চলতি বছর ব্যাংকটিকে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।

যুগান্তররের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়ার কারণে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির মুখে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো।

এ ঘাটতি পূরণে সরকারের কাছেও নগদ অর্থ নেই। বাজেট থেকে তা পূরণ করাও কঠিন। কেননা, চলতি বাজেটে এ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা। এরপরও বাজেট থেকে পূরণ করা হলে সরকারকে বড় চাপের মুখে পড়তে হবে।

ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের ২০০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৫৩ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ২৮৬ কোটি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) ৭৩৭ কোটি টাকা, কৃষি ব্যাংকের ৭ হাজার ৪৮৫ কোটি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৭০৫ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।

সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এ লুটপাটের কথা বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রতিকারের উদ্যোগ নেই।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে লুটপাট হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও । তিনি বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে শুধু পুকুরচুরি নয়, সাগরচুরি হয়েছে।

জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী অভিযোগ করেন, ব্যাংক খাত থেকে টাকা চুরি হয়েছে। সব ব্যাংকের একই অবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকে পচন ধরেছে। ৮০০ কোটি টাকা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চুরি হলো। সব চুরির সঙ্গে ওই ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত। ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে। এগুলো পুকুরচুরি।

একইভাবে জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদ পীর ফজলুর রহমান এ লুটপাটের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ব্যাংক খাতে লুটপাট হচ্ছে। দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে বিদেশে। কিন্তু লুটপাটকারী ও পাচারকারীদের বিচার হচ্ছে না।

পীর ফজলুর বলেন, ঋণের নামে ব্যাংক লুট হচ্ছে প্রতিবছর। চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ২৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। অথচ প্রতিবছরের বাজেটে ব্যাংকগুলোকে করের টাকা থেকে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আর এভাবে ঋণখেলাপিদের উৎসাহিত করছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি কয়েক বছরে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা মূলধন থেকে বরাদ্দ দিয়েছেন ব্যাংকগুলোকে।

এক বছরে দেশ থেকে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে জানিয়ে পীর ফজলুর রহমান বলেন, এসব টাকায় কানাডা, মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ করা হচ্ছে। কানাডার একটি এলাকার নাম হয়ে গেছে ‘বেগমগঞ্জ’। কারণ, ওই এলাকায় বাংলাদেশি বেগম সাহেবারা থাকেন।

পীর ফজলুর বলেন, বিশ্বের কোথাও রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনা ঘটে না। সংসদে দাঁড়িয়ে গতবার অর্থমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন, এ ঘটনার প্রতিবেদন তিনি প্রকাশ করবেন। কথা রাখেননি।

এদিকে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

দ্য ইনস্টিটিউট অফ কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউস্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ আয়োজিত এক আলোচনায় সভায় তিনি বলেন, ব্যাংক সেক্টরে লুটপাট চলছে। এখানে বেসরকারি ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশ। আর সরকারি ব্যাংকের হার সর্বনিম্ন ৩০ শতাংশ। বেসিক ব্যাংকে ৬০, সোনালী ব্যাংকে ৪০, বিডিবিএল-এ ৩০ শতাংশের কাছাকাছি খেলাপি ঋণের হার। পৃথিবীর কোনো দেশে ব্যাংক সেক্টরে এরকম খেলাপি ঋণের হার নেই। অথচ আমাদের ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট করা হচ্ছে। কথা নেই বার্তা নেই, যার ইচ্ছামতো লোকজন বসিয়ে জনগনের টাকা লুট করা হচ্ছে।

লেখক: জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

“পাঠকের কলাম” বিভাগের সকল সংবাদ, চিত্র পাঠকের একান্ত নিজস্ব মতামত, এই বিভাগে প্রকাশিত সকল সংবাদ পাঠক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। তা্ই এ বিভাগে প্রকাশিত কোন সংবাদের জন্য পাঠক.নিউজ কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই দায়ী নয়।”