অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে পারিবারিক আদালতকে আরো কার্যকর করা প্রয়োজন

0
.

জিয়া হাবীব আহসান:
মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস্ ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফ এর এক তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে পারিবারিক আদালতকে আরো কার্যকর করতে ১২ টি ত্রুটি চিহ্নিত করেন এবং ১০ টি সুপারিশমালা পেশ করেন । প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, পারিবারিক আদালতের সুফল পেতে হলে একে আরো কার্যকর ও গতিশীল করতে হবে । দাম্পত্য বিরোধকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সমস্যা দ্রুত নিরসন কল্পে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ-১৯৮৫ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের আওতায় পারিবারিক আদালত স্থাপন করা হয় । পারিবারিক আদালত স্থাপন হচ্ছে আমাদের আইন প্রণেতাদের বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন আইনী চিন্তার (Sophisticated legal thought) ফসল। প্রথাগত দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতসমূহে বিচার প্রার্থী মানুষজন পারিবারিক বিরোধসমূহের প্রতিকার কাঙ্খিত সময়ে লাভ না করায় একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই অধ্যাদেশের অধীন পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠিত হয় ।স্বামী-স্ত্রী,সন্তান-সন্ততি সকলের অধিকার এখানে প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে । অমুসলিমরাও এ আদালতে এ আইনের সুবিধা সমূহ পাবেন । দ্রুততম সময়ে কার্যকরী, ফলপ্রসু ও শান্তিপূর্ণ বিরোধ নিস্পত্তির জন্য পারিবারিক আদালত অদ্যাদেশ-১৯৮৫ প্রকৃত প্রস্তাবে সহনীয় একটি কার্যবিধিমূলক আইন। এই অধ্যাদেশের ৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পারিবারিক বিরোধসমূহ যথা- বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, খোরপোষ, সন্তান-সন্ততির অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান ইত্যাদি বিষয়াদির সবগুলির বা যে কোনটির সাথে সম্পর্কিত বা তা হতে উদ্ভূত যে কোন বিষয়ে মোকদ্দমা গ্রহণ, বিচার ও নিস্পত্তির জন্য পারিবারিক আদালত ক্ষমতাবান । এ বিষয়গুলো ছাড়া পারিবারিক আদালতে অন্য কোন বিরোধ বিচারের আওতাভূক্ত নয় । দ্রুত পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আদালতটি গঠিত হলেও আজ নানা কারনে তা বিচার প্রার্থীদের বিড়ম্বনা ও উৎকন্ঠার কারন হয়ে দাড়িয়েছে । মামলার জট, বিচারক সংকট, সমন নোটিশ জারীতে বিলম্ব এসব নানা কারনে আদালতের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না । এই অধ্যাদেশের আওতায় পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকেই আইনটির প্রয়োগ, পরিধি ও প্রযোজ্যতার বিষয়ে নানা প্রশ্ন জাগে। বিশেষ করে দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের প্রয়োগ ও পরিধি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্ন উঠে । উদাহরণ স্বরূপ অধ্যাদেশটি প্রণয়নের বছর ১৯৮৫ সালে লক্ষ্মীপুর জেলাধীন রামগঞ্জ পারিবারিক আদালতে কোড অব সিভিল প্রসিডিউর এর প্রযোজ্যতার প্রসঙ্গটি আসে যখন বাদী একটি অন্তবর্তীকালীন প্রতিকার প্রার্থনা করেন। যাহোক পরবর্তীতে উচ্চাদালতের অনেক রায়ে এ বিষয়টির অস্পষ্টতা দূর হয়। তম্মধ্যে মকবুল আহমদ বনাম সুফিয়া খাতুন এবং অন্যান্য ৪০ ডি. এল.আর. (হাইকোর্ট ডিভিশন) পৃষ্ঠা-৩০৫, আজাদ আলম বনাম জয়নব খাতুন এবং অন্যান্য ১ বি.এল.সি. (এ.ডি) পৃষ্ঠা-২৪, মোঃ হাফিজুর রহমান বনাম শামছুর নাহার বেগম ১৯৯৮(এডি) প্রণিধানযোগ্য। পারিবারিক আদালত একটি দেওয়ানী প্রকৃতির আদালত এবং Cr.P.C এর ৪৮৮ ধারার অধীনে ম্যাজিষ্ট্রেট কর্তৃক খোরপোষের আদেশ প্রদানের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালত ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতাও প্রয়োগ করেন। এই আইনের ৫ ও ২৩ ধারার বিধানগুলো অনুধাবণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, এই অধ্যাদেশের বিধানাবলী কেবলমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে নহে, অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। পারিবারিক আদালতে আসীন বিচারক ও মামলা পরিচালনাকারী আইনবিদগণ অবশ্যই বিবেচনায় রাখবেন যে, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ-১৯৮৫ নারীর প্রতি সংবেদনশীল একটি আইন। পারিবারিক আদালতে বিচারাধীন মামলাসমূহ বিশেষ করে দেনমোহর ও ভরণপোষন সংক্রান্ত বিরোধসমূহ নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ও জীবন জীবিকার সহিত সম্পর্কিত। তালাকপ্রাপ্ত নারী এবং বিবাহ সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন নারী স্বল্পতম সময়ে দেনমোহর ও ভরণ পোষণের বিচারিক আদেশ লাভ করতে ব্যর্থ হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ-১৯৮৫ এর প্রয়োগিক দিক থেকে কিছু ত্রুটি বিচ্যূতি থাকলেও এ আইনে Pre-trial camera trial and mediation এর মাধ্যমে বিরোধ নিস্পত্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ২০ ধারায় C.P.C ও সাক্ষ্য আইনের প্রযোজ্যতার বিষয়ে সীমাবদ্ধতা থাকলেও মামলা দ্রুত নিস্পত্তির লক্ষ্যে একটি Self contained mode and Method of trial রয়েছে।
পারিবারিক আদালতে মামলাসমূহ দ্রুত নিস্পত্তিতে প্রতিবন্ধকতাসমূহঃ
১) পারিবারিক আদালতের সংখ্যা কম ও বিচারক সংকট মামলা বিলম্বের অন্যতম কারন ।
২) সমন জারীতে অস্বাভাবিক বিলম্ব এবং সমন জারী প্রতিবেদন যথাসময়ে নথির সাথে সামিল না হওয়া । ৭ ধারার বিধান মোতাবেক বিবাদীর হাজির হওয়ার জন্য অনধিক ৩০ (ত্রিশ) দিনের একটি তারিখ ধার্য করার বিধান থাকলেও কখনও কখনও জবাব দাখিলের জন্য বছর এর পর বছর সময় অতিক্রান্ত হওয়া ।
৩) পদাতিক সমনের সাথে সাথে প্রাপ্তি স্বীকারপত্রসহ রেজিষ্ট্রিযোগে মামলার নোটিশ প্রেরণ করার বিধান রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যক্তিগত বা পদাতিক সমন জারী হলেও এ.ডি ফেরতের জন্য অযৌক্তিক কারনে অনির্দিষ্ট সময় রাখা হয় যা মামলায় অযাচিত সময় ক্ষেপন ঘটায়।
৪) অধ্যাদেশের ৭ (৩) ধারায় সমন জারীর ক্ষেত্রে C.P.C এর অর্ডার ৫ রুল ( ৯-২৯) বিধানাবলী প্রযোজ্য এবং এরূপে জারীকৃত সমন বিবাদীর উপর যথাযথভাবে জারী হয়েছে বলে গণ্য হবে। C.P.C এর ১০ ও ১১ ধারার বিধান ছাড়া অন্য কোন বিধান পারিবারিক আদালতের বিচার কার্যধারায় প্রযোজ্য নয় বলে বিচারক ও আইনবিদগণ ভুল ধারানায় উপনীত হন। ফলে সমন জারীর অনিশ্চয়তায় পারিবারিক মামলা সমূহে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। সমন নোটিশ ডাকযোগে প্রেরণ করার ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে তা যথোচিতভাবে জারীকৃত বলে গণ্য করতে হবে ।
৫) ৮ ধারার বিধান মোতাবেক বিবাদী হাজির হওয়ার পর যুক্তিসংগত কারণ প্রদর্শণ করতে সক্ষম হলে অনধিক ২১ দিনের মধ্যে লিখিত বর্ণনা দাখিলের সুযোগ পাওয়ার বিধান থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়না।
৬) মামলার স্ব স্ব দাবীর সমর্থনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিলে পক্ষগণের বিলম্বও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা ।
৭) ৯ ধারার বিধান মোতাবেক বিবাদীর অনুপস্থিতিতে একতরফা বিরোধ নিস্পত্তিতে অনাগ্রহ। একতরফা মামলা দীর্ঘদিন পড়ে থাকা দুঃখজনক ।
৮) সাক্ষ্য উপস্থাপনে এবং সাক্ষ্য লিপিবদ্ধকরণে প্রথাগত পদ্ধতি ব্যবহার করা। ভরণপোষন ও দেনমোহরের মামলায় সাধারণতঃ দেখা যায় প্রতিকার প্রার্থীর চরিত্র উম্মোচনে অশালীন ও কুৎসাব্যাঞ্জক বক্তব্য দেওয়া হয়।এধরনের অজ্ঞতার হেতুতে বা মক্কেল খুশি করতে অপ্রসাংগীক বিষয় বর্জন করতে হবে । ফলে লজ্জা ও মান সম্মানের ভয়ে প্রার্থিক মামলা চালাতে আগ্রহ করে না ।
৯) পারিবারিক আদালতে কখনও কখনও ভরণ পোষনের দাবী বাস্তবতা বিবর্জিত হয় এবং পারিবারিক আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়ও অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
১০) বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিস্পত্তিতে আইনবিদ ও পক্ষগণের অনাগ্রহ এবং বিচারকগণ কর্তৃক পর্যাপ্ত মনোযোগী না হওয়া ও সময় প্রদানে অনাগ্রহ ।
১১) ডিক্রী বলবৎকরণ ও ডিক্রী জারীর ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালত দেওয়ানী আদালত হিসেবে গণ্য হবে এবং এক্ষেত্রে অনেক সময় ডিক্রীর দায় পরিশোধ করার ক্ষেত্রে কিংবা ডিক্রি জারীর ক্ষেত্রে অহেতুক অযাচিত সময় ক্ষেপণ হয়।
১২) আপীল মামলার কোন জটিল আইনগত বিষয় জড়িত না থাকলেও দ্রুত আপীল নিস্পত্তি হয় না।ফলে মামলা সমূহ ঝুলে থাকে ।
পারিবারিক আদালতকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার উপায় সমূহঃ
১) পর্যাপ্ত আদালত সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিচারক নিয়োগ দিয়ে বিদ্যমান সংকট নিরসন করা ।
২) সমন জারীর ক্ষেত্রে অধ্যাদেশের ৭ ধারার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ C.P.C এর আদেশ ৫ বিধি ১৯ এ, ১৯ বি, যথাযথভাবে প্রয়োগ করা। পদাতিক বা ডাক সমন যে কোন একটি জারী হলেই সমন যথাযথভাবে জারী হয়েছে মর্মে গণ্য করা । উভয় সমন মামলা দায়েরের সংগে সংগে বা অনধিক ৩ কার্য দিবসের মধ্যে ইস্যু করতে হবে। বিবাদীর উপস্থিতির তারিখ কোন অবস্থায় এক মাসের অধিক ধার্য্য হবেনা।
৩) সমন জারী হওয়ার পর বিবাদী (Within Time) সময়মত আদালতে হাজির না হলে মামলা দ্রুত একতরফা শুনানীঅন্তে নিস্পত্তি করতে হবে। আদালতে কর্মচারীদের ম্যানেজ করে লম্বা তারিখ নেয়ার কু-প্রথা বন্ধ করতে হবে ।
৪) বিবাদী হাজির হলে জবাব দাখিলের পর Pre-trial Hearing এ বিচারক কার্যকরী ভূমিকা পালন করবেন । মেডিয়েশনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া যা বিচারিক ব্যবস্থার জন্য সাফল্য এনে দেবে ।
৫) মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় Hyper-technicalitics পরিহার করে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ করে দ্রুত সময়ে রায় প্রদান করতে হবে।
৬) আপীল নিস্পত্তিতে জটিল আইনগত বিষয় জড়িত না থাকায় পারিবারিক আপীলগুলো রিমান্ডে প্রেরণ না করে দ্রুত সময়ে নিস্পত্তি করা। পারিবারিক আপীলকে সর্বাধিক গুরুত্ত্ব দিয়ে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট আপীল নিষ্পত্তির কোর্ট সৃষ্টি করা । পারিবারিক আপীল মামলার ক্ষেত্রে বিবাদী/রেসপন্ডেন্ট হাজির হলে ডিক্রিকৃত টাকার অন্তত ৩০% পরিশোধ করার বিধান থাকা ।
৭) পারিবারিক ডিক্রী জারী মামলাগুলো অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকে। পারিবারিক ডিক্রি জারীর ক্ষেত্রে C.P.C এর বিধানসমূহ সহজীকরণ করে তা প্রয়োগ পূর্বক দ্রুত নিস্পত্তি করা।
৮) প্রয়োজনে পারিবারিক আদালতের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ারকে কাজে লাগানো ।
৯) পারিবারিক আদালতের বিচারকের উপর পারিবারিক মামলা ব্যতিরেকে অন্যকোন মামলা শুনানীর অতিরিক্ত দায়িত্ব না দেয়া।
১০) কোন অবস্থাতেই মামলার ধার্য্য তারিখ ৩০ দিনের অধিক না হয় ।
পারিবারিক আদালতে দাম্পত্য সম্পর্ক উদ্ভুত সকল সমস্যা দ্রুত নষ্পত্তি হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন মামলা, পারিবারিক সহিংসতা নিরোধ, যৌতুক নিরোধ, গার্ডিয়ানশীপ মামলাসহ বহু মামলার পাহাড় কমে যাবে এবং জনগন বিচার ব্যবস্থার প্রকৃত সুফল পাবে ।

লেখকঃ আইনবিদ, কলামিস্ট, সু-শাসন ও মানবাধিকার কর্মী।